মরমী কবি হাসন রাজা'র জন্ম পরিচয়ঃ
হাসন রাজা যার ছদ্মনাম নাম দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী বা দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী ।তিনি ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ - ৬ ডিসেম্বর ১৯২২, ৭ পৌষ ১২৬১ - ২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ ছিলেন বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। তার প্রকৃত নাম ছিল অহিদুর রাজা সিলেটিরা রাজা শব্দটিকে রেজা বা রজা বলেন বা লিখেন তাই উনাদের নামে রেজা বা রজা লিখা ছিল তবে আসলে শব্দটি রাজা হবে । আসল শব্দ বা নামটি হলো অহিদুর রাজা কিন্তু তিনি হাসন রাজা নামেই সুপরিচিত ছিলেন । মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্ এর প্রধান পথিকৃ। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
দেওয়ান হাসন রাজা ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান । তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর তৃতীয় পুত্র। আলী রাজা তাঁর মাসতুতো /খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাছন রাজার জন্ম। হাছনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তার অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তাঁরই নামের অনুকরণে বা আকারে তাঁর নামকরণ করেন অহিদুর রাজা।
হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।
বাল্যকালঃ
তৎকালীন সময়ে সিলেটে আরবি , ফার্সি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তখন সিলেটের ডেপুটি কমিশনার অফিসের কর্মকর্তা নাজির আবদুল্লা যিনি ফার্সি ভাষা বিশেষজ্ঞ বলে খ্যাত , তার ভাষ্যমতে তার পরামর্শেই হাসন রাজা নামকরন করা হয়। তৎকালীন সময়ে বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন- হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, "বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো (পৃ. ১৪, ঈদ সংখ্যা হানাফী ১৩৪৪)। তার ছিলনা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ্যের মতে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। স্বশিক্ষিত হওয়া সত্যেও তিনি আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচন করে গেছেন। যা গান প্রেমিদের হ্রদয়কে আচ্ছন্ন করে বেড়ায়। সংগীত জীবনঃ
হাসন রাজা বাংলাদেশের প্রমুখ গায়ক ও সংগীত শিল্পীগণের একজন। তিনি ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের সংগীত ইন্ডাস্ট্রির জগতে প্রবেশ করেন এবং তার গানের মাধ্যমে একটি প্রভাবশালী স্থান অধিকার করেন।
হাসন রাজা প্রাথমিক শিক্ষা স্থানীয় স্কুলে শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সংগীতের ক্ষেত্রে একজন স্বাধীন গায়ক হিসেবে পরিচিত হন এবং তার গানের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রজন্মের মাঝে প্রিয় হয়ে উঠেছেন।
হাসন রাজা যাত্রা শুরু করেন ছোট্ট প্রয়োজনীয় সমর্থন গ্রুপের সঙ্গে, এবং তার প্রথম গান প্রকাশ হয় ১৯৯০ সালের 'দুই চোখ দুই নকশা' নামক অ্যালবামে। এরপর তিনি এক পর্যায়ে 'স্বপ্ন' নামক আরও একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন, যা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
হাসন রাজা তার গানের মাধ্যমে প্রেম, জীবনের দুঃখ-সুখ, পরিবার, দেশ ও সমাজের বিভিন্ন মূল্যবোধনা নিয়ে গান গায়েন। তার গানের কিছু জনপ্রিয় গানের মধ্যে 'হঠাৎ কি ছেড়ে আসা', 'মন বলে বড় বড় প্রেম করে', 'এক নদীর নাম' ইত্যাদি উল্লিখিত হতে পারে।
হাসন রাজা বাংলাদেশের পপ সংগীতে একটি প্রভাবশালী স্থান অধিকার করেন এবং তার সংগীত অনেক মানুষের দিনের জীবনের সাথে সাথে সম্পর্ক করে। তিনি বাংলাদেশের সংগীত ইন্ডাস্ট্রির একজন অত্যন্ত প্রিয় ও মর্চান্ত গায়ক হিসেবে বিশেষভাবে প্রশংসিত হন।
হাসন রাজার জনপ্রিয় গান সমূহঃ
একদিন তোর হইবো রে মরণ
মাটির পিঞ্জরার মাঝে বন্দি হইয়া
হাছন রাজায় কয়
লোকে বলে বলেরে
সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো
আমি যাইমু ও যাইমু
আগুন লাগাইয়া দিলো
নিশা লাগিলো রে
তুমি যে ক্ষতি করলা আমার
রঙ্গিয়া রঙ্গে আমি মজিয়াছি রে
যমের দূতে আসিয়া
বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি......
আল্লা ভব সমুদ্ রে
আমি না লইলাম আল্লাজির নাম
আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা
চলচ্চিত্রঃ
হাসন রাজার জীবনের উপর ভিত্তি করে প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তি পায় 'হাসন রাজা' ২০০২ সালে। যার পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম এবং প্রযোজনা করেন এই চলচ্চিত্রের মূখ্য অভিনেতা হেলাল খান। এতে আরো বাংলার বিখ্যাত অভিনেতা অভিনয় করেছেন যারা হলেন ববিতা, সিমলা, অমল বোস প্রমূখ।
হাসন রাজার ২য় জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র 'হাসন রাজা' যা মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। এটি বাংলাদেশ- ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র, যা পরিচালনা করেন রুহুল আমিন। এতে অভিনয় করেন কলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী এবং অভিনেত্রী রাইমা সেন।
মৃত্যুঃ
হাসন রাজার কবর
বাংলার বিখ্যাত বাউল হাছন রাজা ৭ই ডিসেম্বর, ১৯২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সুনামগঞ্জ পৌর এলাকাধীণ গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তিনি চলে গেলেও তার রেখে যাওয়া গান গুলো রয়ে গেছে লক্ষ্য মানুষের হ্রদয়ে।
********************************************************************
কোন মন্তব্য নেই: