সংগীতের লয়, মাত্রা ও তাল কী ???

 


 লয়ঃ

সঙ্গীতের গতিকে লয় বলে। গতির তারতম্যের জন্য লয়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায় - 

১) ধীরগতির সঙ্গীতের জন্য বিলম্বিত লয়

২) দ্রুতগতির সঙ্গীতের জন্য দ্রুত লয় এবং 

৩) মধ্যগতির সঙ্গীতের জন্য মধ্য লয়। 

মধ্য লয় বিলম্বিত লয়ের দ্বিগুণ ও দ্রুত লয়ের অর্ধেক গতির হয়ে থাকে। 

মাত্রা সঙ্গীতের লয় বা গতির দুরত্ব মাপার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেকটি মাত্রার মধ্যবর্তী ব্যবধান সমান হয়। কয়েকটি ছন্দোবদ্ধ মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় একটি তাল

তালের নির্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়। লয় প্রধানত তিন প্রকার-

০১. বিলম্বিত লয় ,

০২. মধ্য লয় এবং ,

০৩. দ্রুত লয়। 

তবে বিশেষজ্ঞ গণ মনে করেন লয় আট প্রকার। এ ছাড়াও মাত্রার ভগ্নাংশ দ্বারা গঠিত বহুপ্রকার লয় হতে পারে যেমন: আড়,কুয়ড়,বিয়াড় ইত্যাদি। 

তালঃ

তালের মোট সময়টিকে পরিমাপ করার জন্য যে ক্ষুদ্রতম একক ব্যবহার করে লয়কে নির্দিষ্ট করা হয়, এক কথায় তাই মাত্রা। তাল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়কে নির্দিষ্ট ক্ষুদ্রভাগে ছন্দবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে তাল যন্ত্রে বাদনের মধ্য দিয়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো। প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু অবলোকন করি তার সবকিছুই ছন্দবদ্ধ ভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটে চলেছে অর্থাৎ সবই তালবদ্ধ। একারণে সব কিছুই আমাদের কাছে এত সুন্দর আর মনোরম বলে মনে হয়। আমরা রেলগাড়ীতে চড়লে এর প্রচন্ড শব্দের মাঝেও ঘুমিয়ে পড়ি কারণ এর চলার গতি ছন্দবদ্ধ ও এর গতি প্রায় সমান থাকে অথচ হঠাৎ ব্রেক কষলেই আমরা চমকে উঠি কারণ তখন চলার ছন্দ পতন ঘটে। তাই তাল হচ্ছে সঙ্গীতের প্রাণ যার বিচ্যুতি আমাদের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সঙ্গীত জগতে হাজারো তালের জন্ম হয়েছে আবার হারিয়েও গিয়েছে অনেক। তাল যন্ত্রও আছে হাজারো রকমের। এর সবগুলোই যে আমাদের জানতেই হবে তা নয়। প্রাথমিক ভাবে আমরা কিছু তালের সাথে যদি পরিচিত হতে পারি তবে তা আমাদের জ্ঞানের দুয়ার ধীরে ধীরে খুলে দেবে।

বিভিন্ন প্রকার তালঃ

ত্রিতাল

ত্রিতাল শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি বহুল ব্যবহৃত তাল। ত্রিতাল ১৬ মাত্রা বিশিষ্ট সমপদী তাল। এর পদ-সংখ্যা = ৪, ছন্দ-বিভাগ = ৪/৪/৪/৪ । এর তিনটি তালি ও একটি ফাঁক, তাই এর নাম তিনতাল বা ত্রিতাল বা তেতাল বা তেতালা । শ্ব্ত্রি্তাশলের বোল:

  • +ধা ধিন্ ধিন্ ধা । ধা ধিন্ ধিন্ ধা । না তিন্ তিন্ তা । তেটে ধিন্ ধিন্ ধা ।। ধা

কাহার্‌বা তাল

কাহার্‌বা, কাহেরবা, কার্ফা, ইত্যাদি নামে পরিচিত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ৪-৪ ছন্দের জন্যে ত্রিতাল ব্যবহার বেশি হলেও লঘু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ৪-৪ ছন্দের জন্যে কাহারবাই সর্বাধিক ব্যবহৃত। কাহার্‌বা আট মাত্রার একটি সমপদী তাল। চতুর্মাত্রিক (৪-৪) ছন্দ। এর দুটি বিভাগ - একটি তালি ও একটি খালি। কাহারবার বোল:

  • +ধাˈ গেˈ নাˈ তিˈ । নাˈ কˈ ধিˈ নাˈ ।। 
  • +ধাˈ গেˈ তেˈ টেˈ । নাˈ কˈ ধিˈ নাˈ ।।
  • +ধা' আ' তে' টে'।

oতা' গ' ধে' নে'।।

দাদ্‌রা তাল

এটি একটি ছয় মাত্রার সমপদী তাল। এর ছন্দ ত্রিমাত্রিক। এর দুটি বিভাগ - একটি তালি ও একটি খালি। তালি ১ মাত্রায় ও খালি ৪ মাত্রায়। দাদ্‌রার বোল নিম্নরূপ:

  • +ধাˈ ধিনˈ নাˈ । নাˈ থুনˈ নাˈ ।। 
  • +ধাˈ ধিˈ নাˈ । নাˈ তিˈ নাˈ ।।

খেমটা তাল

দাদ্‌রার ন্যায় 'খেমটা তালটিও ৬ মাত্রায় গঠিত। এতে আছে ১টি তালি বা আঘাত ; ১টি অনাঘাত বা ফাঁক। বোল নিম্নরূপ:

  • +ধাগে কৎ তা ধাগে ধিন ধাধা

তেওরা তাল

তেওরা তালের আরেক নাম তেওট। এটি সাত মাত্রার বিষমপদী তাল। প্রথম বিভাগটি তিন মাত্রার এবং পরের দুটি প্রতিটি দুই মাত্রার। এতে তিনটি তালি আছে এবং কোন ফাঁক নেই। বিভিন্ন বোলে এটি বাজানো যায়। তবে সচরাচর যে সকল বোলে তবলায় সঙ্গৎ করা হয় সেগুলোর কয়েকটি হলো:

  • +ধা দেন্ তা । তিট কতা । গদি ঘিন ।।
  • +ধা কৎ তা । ধিন ধা। ত্রেকে ধিন ।।

রূপক তাল

রূপক তেওরার অনুরূপ একটি তাল। এটিও সাত মাত্রার বিষম্পদী তাল। প্রথম বিভাগটি তিন মাত্রার এবং পরের দুটি প্রতিটি দুই মাত্রার। রূপক তালে ১টি ফাঁক, ২টি আঘাত ; তবে এতে প্রথমেই সম-এর ঘরে ফাঁক। বোল নিম্নরূপ:

  • তী তী না । ধী না । ধী না ।।
  • তিন তিন তাক । ধিন ধাগে । ধিন ধাগে ।।

ঝাঁপতাল

ঝাঁপতাল এটি ১০ মাত্রায় গঠিত। এর অন্য নাম পাত্‌রা। এতে আছে ৩টি তালি বা আঘাত ; ১টি অনাঘাত বা ফাঁক। বোল নিম্নরূপ:

  • +ধিন ধা ধিন ধিন ধা
0কৎ তা ধিন ধিন ধা ।

ধা বা ধিন ।বা ধিনা ধিধি না , তিনা ধিধি না

একতাল

একতাল ১২ মাত্রা বিশিষ্ট একটি সমপদী তাল। এই তালটি তিন প্রকার। যথা: ক)দ্বিমাত্রিক একতাল খ)ত্রিমাত্রিক একতাল গ)চতুর্মাত্রিক একতাল। এছাড়াও বিলম্বিত একতাল বাজানোর সময় এর প্রতিটি মাত্রা চার মাত্রার সমান করে টেনে বাজানো হয়,ফলে তা ৪৮ মাত্রার মত মনে হলেও মূলত: তা দ্বিমাত্রিক একতাল ১২ মাত্রার একটি বিলম্বিত রুপের ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।

  • +ধিন ধিন।ধাগে তেরেকেটে।তু না।কৎ তা।ধাগে তেরেকেটে। ধি না।।
  • +ধিন ধিন না।তেরেকেটে তু না।কৎ তু না।তেরেকেটে ধি না।।
  • +ধিন ধিন ধা ধা। দেন তা তা ধিন।ধাগে তেরেকেটে তুনা কৎতা।।

চৌতাল

মাত্রা সমষ্টি ১২। পদ সমষ্টি-৬। সমপদী ছন্দ। দ্বিমাত্রিক পদ।৪ তালি, ২ খালি। পদ/ বিভাগ- ২।২।২।২।২।২।

ঠেকাঃ

  • +ধা ধা।দেন তা। কৎ তাগে। দেন তা। তেটে কতা। গদি ঘেনে।। +ধা

বিভিন্ন অপ্রচলিত তালঃ

এছাড়াও কয়েকটি অপ্রচলিত তাল রয়েছে; এগুলো হলোঃ

  • তাল খামসা;
  • পটতাল;
  • মোহন তাল;
  • দোবাহার;
  • ধামার।

তাল খামসা ৮ মাত্রার তাল, যাতে ৫টি তালি এবং ৩টি ফাঁক আছে। পটতাল ৪ মাত্রার, এতে ১ টি তালি এবং ১টি ফাঁক। মোহন তাল ১২ মাত্রায় গঠিত, এতে তালি ৭টি, ফাঁক ৫টি। ১৩ মাত্রার দোবাহার তালে তালি ৯টি এবং ফাঁক ৪টি। ধামার ১৪ মাত্রায় গঠিত, এতে ৩টি তালি এবং ১টি ফাঁক থাকে।

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.