বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম‌-shah abdul karim

                              

                       

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম‌-shah abdul karim

                   বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম‌(১৯১৬-২০০৯)

 যদি বাংলাদেশের সংগীত নিয়ে কথা বলি তাহলে যে শিল্পির কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তী সংগীতজ্ঞ, সাধক, বাউল শিল্পি ও বাউল সম্রাট হিসেবে খ্যাত  "শাহ আব্দুল করিম"। তিনি বাংলায় অসাধারণ কিছু গানের গীতিকার ও সুর করে গেছেন, যে গান গুলো শুনলে আজও মনে অতৃপ্ত রয়ে যায়।যেমনঃ বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না ও রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না ইত্যাদি।

                                                            জন্ম পরিচয়ঃ 

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম‌ ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ সালে উজানধল, দিরাই, সুনামগঞ্জ মহকুমা, সিলেট, আসাম, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) এ জন্ম গ্রহণ করেছেন। তার পিতার ইব্রাহিম আলী মাতার নাম নাইওরজান। তিনি খুব ছোটবেলায় তার গুরু বাউল শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশ থেকে সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। তিনি আফতাব-উন-নেসা কে বিয়ে করেন, যাকে তিনি সরলা নামে ডাকতেন। তিনি ১৯৫৭ সাল থেকে তার জন্মগ্রামের পাশে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

 

                                                সঙ্গীতের প্রাথমিক জীবনঃ

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম‌ ছিলেন ভাটি অঞ্চলের মানুষ। তাই তিনি ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোন কিছু তাকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি বাউলগানের দীক্ষা লাভ করেছেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন

 

                                                            সঙ্গীত সাধনাঃ

স্বশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। বাউলসাধক শাহ আবদুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা তিনি কখনোই গ্রহণ করেননি। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে জীবন্ত কিংবদন্তিঃ বাউল শাহ আবদুল করিম নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এই অ্যালবামের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ তার বার্ধক্যজনিত রোগের চিকি‍ৎসার জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়। ২০০৭ সালে বাউলের জীবদ্দশায় শাহ আবদুল করিমের জীবন ও কর্মভিত্তিক একটি বই প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়, ‘শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন-গ্রন্থ’ (উৎস প্রকাশন) নামের এই বইটি সম্পাদনা করেন লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক সুমনকুমার দাশ। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী ২০০৯ সালের ২২ মে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি ড. জাফর আহমেদ খানের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গ্রন্থ 'শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র' প্রকাশিত হয়। বইটির পরিবেশক বইপত্র। 

                      শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় কিছু গানঃ 

  • আমি কূলহারা কলঙ্কিনী
  • কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
  • কোন মেস্তরি নাও বানাইছে
  • কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
  • বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
  • আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
  • গাড়ি চলে না
  • রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না
  • তুমি রাখ কিবা মার
  • ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুরপংখী নাও
  • তোমার কি দয়া লাগেনা
  • আমি মিনতি করিরে
  • তোমারও পিরিতে বন্ধু
  • সাহস বিনা হয়না কভু প্রেম
  • মোদের কি হবেরে ,
  • মানুষ হয়ে তালাশ করলে
  • আমি বাংলা মায়ের ছেলে
  • মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও
  • আমি তোমার কলের গাড়ি
  • সখী কুঞ্জ সাজাও গো
  • জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে
  • যে দুংখ মোর মনে
  • হুরু থাকতে,আমরা কত খেইর (খেইল) খেলাইতাম
  • হাওয়াই উরে আমার
  • গান গাই আমার মনরে বুঝাই
  • দুনিয়া মায়ার জালে
  • মন মিলে মানুষ মিলে, সময় মিলেনা
  • সখী তুরা প্রেম করিওনা
  • কাছে নেওনা ,দেখা দেওনা
  • মন মজালে,ওরে বাউলা গান
  • আমার মাটির পিনজিরাই সোনার ময়নারে
  • নতুন প্রেমে মন মজাইয়া
  • বসন্ত বাতাসে সইগো
  • আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু
  • আমি তরে চাইরে বন্ধু
  • কাঙ্গালে কি পাইব তোমারে
  • বন্ধুরে কই পাব
  • এখন ভাবিলে কি হবে
  • আসি বলে গেল বন্ধু আইলনা
  • আমি কি করি উপায়
  • প্রান বন্ধু আসিতে কত দুরে
  • বন্ধু ত আইলনাগু সখী    

 

                                                        তার প্রকাশনাঃ

বাউল শাহ আবদুল করিমের এ পর্যন্ত প্রায় ৭টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তার রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়াও সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আব্দুল করিম স্মারকগ্রন্থ (অন্বেষা প্রকাশন) তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। এর আগে-পরে শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে সুমনকুমার দাশের ‘বাংলা মায়ের ছেলে : শাহ আবদুল করিম জীবনী’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘সাক্ষাৎ কথায় শাহ আবদুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘শাহ আবদুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম’ (উৎস প্রকাশন), ‘গণগীতিকার শাহ আবদুল করিম’ (উৎস প্রকাশন) প্রকাশিত হয়। সর্ব শেষ ২০১৬ সালে ঢাকার প্রখ্যাত প্রকাশনাসংস্থা প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয় সুমনকুমার দশের ‘শাহ আবদুল করিম : জীবন ও গান’ বইটি। এ বইটি ইতোমধ্যেই একটি প্রামণ্য জীবনী হিসেবে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। এ বইটিতে করিমের নির্বাচিত বেশ কিছু গানও সংকলিত হয়েছে। শাহ আবদুল করিমের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস সাইমন জাকারিয়া রচিত "কূলহারা কলঙ্কিনী" প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। 

                           প্রকাশিত বইয়ের তালিকাসমূহঃ

  • আফতাব সঙ্গীত (১৩৫৫ বাংলা; আনুমানিক ১৯৪৮)
  • গণ সঙ্গীত (১৯৫৭)
  • কালনীর ঢেউ (১৩৮৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন; ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর)
  • ধলমেলা (১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১ ফাল্গুন; ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি)
  • ভাটির চিঠি (১১ বৈশাখ ১৪০৫; ২৪ এপ্রিল ১৯৯৮)
  • কালনীর কূলে (নভেম্বর ২০০১)
  • শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র (সংকলন ও গ্রন্থন: শুভেন্দু ইমাম, ২২ মে ২০০৯)                                                      

                                                          সম্মাননাঃ

বাউল শাহ আব্দুল করিম বাংলা সঙ্গীতে তার অসামান্য অবদানের জন্য  ২০০১ সালে একুশে পদক, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪) ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬) সহ বহু পরুস্কারে ভূষিত হন। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ভাটির পুরুষ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এছাড়াও সুবচন নাট্য সংসদ তাকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের ৮৮টি প্রদর্শনী করেছে।

                                                এক নজরে তার পদক সমূহঃ 

  • একুশে পদক (২০০১)
  • কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক (২০০০)
  • রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০)
  • লেবাক এ্যাওয়ার্ড (২০০৩)
  • মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪)
  • সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫)
  • বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬)
  • খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮)
  • বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা (২০০৮)
  • হাতিল এ্যাওয়ার্ড (২০০৯)
  • এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯)                                                             
                                                                         

                                                              মৃত্যুঃ

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মৃত্যু বরণ করেন ১২ই সেপ্টেম্বর ২০০৯ (বয়স ৯৩) সুনামগঞ্জ, সিলেট, বাংলাদেশ । সেই দিন শনিবার সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ হারায় একজন বিশেষ বাউল সম্রাটকে। সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আব্দুল করিমকে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর থেকেই লাইফসাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল।

******************************************************************************


 

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.